সিগারেট ছাড়বেন কীভাবে?

আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা বারবার সিগারেট খাওয়া ছাড়ার চেষ্টা করেছেন। পারেননি। এমনও হয়েছে, ধূমপান ছেড়েছেন। তারপর একটা দিন এবং সেই দিনের লাগোয়া রাতটি কোনওভাবে কাটিয়েও দিয়েছেন। পরদিন সকালে আর থাকতে না পেরে ঘুম থেকে উঠেই দোকানে দৌড়ে গিয়েছেন সিগারেট কিনতে!
কেন এই বদভ্যাস বাগে আনা মুশকিল: আসলে সিগারেট ছাড়ার পরে প্রথমদিন সেভাবে কোনও সমস্যা হয় না। কারণ তখনও রক্তে নিকোটিন রয়ে যায়। জটিলতা দেখা দেয় তার পরদিন থেকে। রক্তে নিকোটিনের ঘাটতি শুরু হয়। মস্তিষ্কের ‘প্লেজার সার্কিট’ বা যে অংশ থেকে আমাদের মেজাজ নিয়ন্ত্রণ হয়, সেখানে নিকোটিনের জন্য তৈরি হয় প্রবল চাহিদা। এই চাহিদা তৈরি হয় আসক্তির কারণে।
নিকোটিনের খেলা: শুনে অবাক লাগতে পারে, তবে নিকোটিন কিন্তু প্রকৃতপক্ষেই আসক্তি তৈরি করে। এই আসক্তি মদ, গাঁজা, ড্রাগের নেশার সঙ্গে তুলনীয়। আর আসক্তি থাকলে তার উইথড্রল এফেক্টও থাকে। আসলে সিগারেট ছাড়ার পরেই নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক উপসর্গ দেখা দেয়। বিশেষত কারও কারও মনে হয়, কোনও কাজেই একবিন্দু মনোনিবেশ করা যাচ্ছে না। মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কোনও কথা কানে ঢুকছে না। মনে হচ্ছে গোটা দেহটা যেন এখনই যন্ত্রণায় দুমড়ে-মুচড়ে উঠবে! কারও চিৎকার করে কাঁদতেও ইচ্ছে হয়। সর্বোপরি প্রতি সেকেন্ডে মনে হয়, ‘একটা সিগারেট খেলে কী ক্ষতিই বা হবে!’ কারও কারও রাতে ঘুমও নষ্ট হয়ে যায়। কিছু ব্যক্তির আবার প্রাতঃকৃত্যের সময় একটা সিগারেট ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখার অভ্যেস থাকে। সিগারেট ছাড়া তাঁদের পক্ষে সেই স্বাভাবিক নিত্যকর্ম করাও অসম্ভব হয়ে যায়! যাঁরা ধূমপান করেন না, তাঁদের কাছে এই ধরনের অনুভব হাস্যকর বা বিস্ময়কর মনে হতে পারে। কিন্তু প্রতিটি উপসর্গই আসলে দিনের আলোর মতোই সত্যি!
কেন চেইন স্মোকিং-এ আসক্তি: নিকোটিন মস্তিষ্কে দুই ধরনের রাসায়নিকের ক্ষরণ বাড়ায়। ‘ডোপামিন’ এবং ‘নরঅ্যাড্রিনালিন’। এই কেমিক্যাল দু’টি একজন ব্যক্তির মেজাজ ভালো রাখতে এবং সামান্য মাত্রায় হলেও মনঃসংযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। এই কারণেই অনেকে বলেন, সিগারেট খাওয়ার পর আনন্দ পাচ্ছেন ও কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন। প্রথমদিকে সামান্য মাত্রার নিকোটিনেই এই প্রভাব পাওয়া গেলেও, পরবর্তীকালে ব্রেন ওই সামান্য মাত্রার নিকোটিনে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তাই আগের ফলাফল পেতে হলে আরও বেশি মাত্রায় নিকোটিন গ্রহণ করতে হয়। এই কারণেই ধূমপায়ীরা নিজেকে আর একটি বা দু’টি সিগারেটে বেঁধে রাখতে পারেন না! দিন দিন সংখ্যা বাড়তেই থাকে।
সিগারেট ছাড়বেন কীভাবে: তাহলে কি সত্যিই সিগারেট ছাড়া যায় না? প্রশ্নের জবাবে বলা যায়— চাইলে আজ, এই মুহূর্ত থেকেই ধূমপানের অভ্যেস ত্যাগ করা সম্ভব। তাহলে ধূমপায়ীরা চাইলেও ধূমপান ছাড়তে পারেন না কেন? কারণ আর কিছুই নয়— ‘ক্রেভিং’ বা শরীরে নিকোটিনের চাহিদা। দেখা যাক সিগারেট ছাড়ার পর কীভাবে নিকোটিনের চাহিদা শরীরে তৈরি হয় ও কতদিন থাকে। ক্রেভিং-এর প্রতি শরীর কীভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে, সে সম্পর্কেও ধারণা করা যাক—
প্রথম ৩০ মিনিট থেকে ৪ ঘণ্টা: কিছু ধূমপায়ীর ক্ষেত্রে একবার সিগারেট খাওয়ার পর প্রভাব থাকে আধঘণ্টা। কারও ক্ষেত্রে এই প্রভাব থাকে চার ঘণ্টা! ফলে ওই ব্যক্তির শরীরে আধঘণ্টা বা চার ঘণ্টা পর নিকোটিনের জন্য চাহিদা ও ধূমপানের ইচ্ছে তৈরি হতে থাকে। প্রশ্ন হল, ধূমপানের যে চাহিদা দেহ-মনে তৈরি হয়, তার স্থায়িত্ব কতক্ষণ? ধূমপান ছাড়ার পরে প্রথম দিকে সিগারেটের যে চাহিদা দেহ-মনে তৈরি হয়, তার স্থায়িত্বকাল ১৫ থেকে ২০ মিনিট! শেষ সিগারেটটি খাওয়ার পর থেকে এই চাহিদা নরকের শয়তানের মতো বারংবার মস্তিষ্কে হানা দিতে থাকে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। চাহিদা মিনিট পনেরো স্থায়ী হলেও প্রথম পাঁচ মিনিট লড়াই করাটাই হল আসল।
১০ ঘণ্টা: অস্থির লাগে। গোটা শরীরটা যেন পেটের ভিতর সিঁধিয়ে যেতে চায়। মনে হয়, সময় যেন ধীর গতিতে বয়ে যাচ্ছে। দিন যেন শেষ হতে চায় না!
২৪ ঘণ্টা: শরীরে অস্বস্তি শুরু হয়। খিদে বেড়ে যায়। অস্থির লাগে।
দ্বিতীয় দিন: মাথা ব্যথা শুরু হয়। কারণ নিকোটিন শরীর ছেড়ে বেরতে থাকে।
তৃতীয় দিন: নিকোটিন শরীর থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে যায়। এবার সিগারেটের জন্য চাহিদা কমতে থাকে। তবে দুশ্চিন্তা করার প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে।
প্রথম সপ্তাহ: এবার অনেকটাই নিশ্চিন্ত। এখন আপনার উচিত সেই সমস্ত পরিস্থিতি এড়িয়ে চলা যেগুলি সিগারেট খেতে উস্কানি দেবে!
দ্বিতীয় সপ্তাহ: মাঝেমধ্যে সিগারেটের জন্য চাহিদা তৈরি হবে। বিশেষ করে দুশ্চিন্তা’র সময় সিগারেটের জন্য মন আনচান করবে। তবে আপনি সেই পরিস্থিতি এড়াতে পারবেন।
মুশকিল হল, প্রথম সপ্তাহেই বহু ধূমপায়ী ক্রেভিং সহ্য করতে না পেরে ফের সিগারেট ধরে ফেলেন।
সফলভাবে সিগারেট ছাড়ার উপায়
ধূমপায়ীরা সাধারণত সিগারেট দু’ভাবে ছাড়ার চেষ্টা করেন— ক) প্যাকেটে যতগুলি সিগারেটই থাকুক না কেন, মুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলে সেই মুহূর্ত থেকে সিগারেট ছেড়ে দেওয়া মনস্থ করেন। খ) প্যাকেটের শেষ সিগারেটটি বের করে ধীরেসুস্থে খান। তারপর ভাবেন ‘ছাড়লাম’।
মনকে শক্ত করলেই জিতবেন:
মনে রাখবেন, সিগারেট খাওয়া কমিয়ে িদয়ে ধূমপান সাধারণত ছাড়া যায় না। সেক্ষেত্রে উপরিউক্ত দু’টি মুহূর্তই যথেষ্ট নাটকীয় হলেও অনুসরণ করা যায়। তবে মুশকিল শুরু হয় ধূমপান ছাড়ার আধঘণ্টা পর থেকে। কে যেন মাথায় উঁকি মেরে টুক করে বলে যায়— ‘সিগারেট!’ বলেই পালিয়ে যায়। অতএব এই ক্রেভিং সামলানোর উপায় জানলেই জিত সম্ভব। আর তারও আগে একটা বিষয় নিজেকে বোঝাতে হবে যে— ‘সিগারেট ছাড়লেই উইথড্রল এফেক্ট শুরু হবে। আর সেই উইথড্রল এফেক্টের সঙ্গে আমাকে দাঁত চেপে লড়তে হবে। সামান্য এই লড়াইয়ে হার মানার পাত্র আমি নই। আমি জিতবই।’
অন্য কাজে ব্যস্ত হন: সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছে হলেই নিজেকে অন্য কাজে ব্যস্ত করে ফেলুন। ঘরটা একটু গুছিয়ে নিন। মোবাইলে গেম খেলুন। একটু জল পান করুন। পুরনো বন্ধুকে ফোন করুন। একটু গান গেয়ে নিন। গাছে জল দিন। এমনকী চ্যুইং গাম বা নিকোটিন গাম মুখে ফেলে চিবোতে পারেন। মোট কথা লক্ষ্য একটাই— মাথার মধ্যে ‘সিগারেট-সিগারেট-সিগারেট’ বলে যে শৃঙ্খল তৈরি হচ্ছে তা ভাঙা!
ক্রেভিং মারাত্মক হলে: কিছু কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে ক্রেভিং এতটাই মারাত্মক হয়ে ওঠে যে কাজে মনোনিবেশ করতে পারেন না। এমন হলে ব্রেক নিন। কাজ ছেড়ে উঠুন। পাঁচ মিনিট একটু ঘোরাঘুরি করুন। জল পান করুন। লম্বা লম্বা শ্বাস নিন। অস্থিরতা কমে গেলে ফের কাজে মনোনিবেশ করুন। একটা কথা মনে রাখবেন, প্রথম তিন দিন বারবার এমন করার দরকার পড়তে পারে। আর প্রতিবারই সফল হওয়ার পর নিজেকে বলুন ‘আমি পেরেছি। পরিবারের জন্য আমাকে জিততেই হবে।’ আরও একটা বিষয় মাথায় রাখলে ভালো। আর তা হল— যত দিন যাবে তত আপনি বুঝতে পারবেন, আগের মতো লড়াই করতে হচ্ছে না। লড়াইটা ক্রমশ সহজ হয়ে যাচ্ছে!
ধূমপায়ীদের আড্ডা এড়িয়ে যান: অনেকেই আছেন যাঁরা বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে করতে ধূমপান করেন। এমন আড্ডা এড়িয়ে যান।
পরিবারের সাহায্য নিন: ধূমপান ত্যাগের পর মনমেজাজ খারাপ থাকে। ছোট্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে পরিবারের সদস্যের সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তাই আগে থেকে নিকটজনকে বলুন প্রথম সাত দিন একটু আপনাকে সাহায্য করতে ও মেজাজের সঙ্গে মানিয়ে নিতে।
চিকিৎসকের সাহায্য নিন: সিগারেট ছাড়তেই হবে, অথচ সফল হচ্ছেন না, এমন হলে চিকিৎসকের সাহায্য নিতে পারেন। প্রয়োজনে তিনি বুপ্রোপায়ন জাতীয় ওষুধ দিতে পারেন।
সফল হওয়ার পরে: ধরে নেওয়া যাক আপনি সিগারেট ছাড়তে সফল হয়েছেন। কেটে গিয়েছে তিনমাস। হতে পারে কেটে গিয়েছে একবছর! জানলে অবাক হবেন, ১ বছর পরেও মাঝেমধ্যে সিগারেট খাওয়ার জন্য ইচ্ছে তৈরি হবে। এমনকী এই ক্রেভিং সিগারেট ছাড়ার ২০ বছর পরেও তৈরি হতে পারে! তবে আপনি এখন আর আগের মতো দুর্বল নন। মানসিকভাবে অনেক বেশি পরিণত। আপনি জানেন কী অনায়াসে ধূমপানের হাতছানি এড়ানো যায়। আর আপনি এও জানেন সিগারেটহীন পৃথিবীটা আসলে অনেক অনেক বেশি ঝকঝকে, রঙিন আরও বেশি সুন্দর আর প্রাণবন্ত! সিগারেট না ছাড়লে আপনি জীবনের এই দিকটা সম্পর্কে অজ্ঞাত থেকে যেতেন!